সন্দীপ সরকার, কলকাতা: ‘বছর দুয়েক আগের কথা ভেবে দেখুন। দেশ ছেড়ে কাতারে কাতারে মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন ভিনদেশে। ভিটেবাড়ি ছেড়ে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। আর সেই দেশের ক্রিকেটারেরা কী খেলাটাই না খেলল! ক্রিকেটেও ওদের মুক্তি যেন…’
আফগান ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য
কথাগুলো বলছিলেন যিনি, বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত তিনিই আফগানিস্তান (Afghanistan) ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য ছিলেন। রশিদ খান (Rashid Khan), মহম্মদ নবি (Mohammed Nabi), হাশমাতুল্লাহ শাহিদি, রহমানুল্লাহ গুরবাজ়দের উত্থানের নেপথ্যে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সদ্যসমাপ্ত ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচের চারটি জিতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন আফগানরা। অল্পের জন্য সেমিফাইনালে ওঠা হয়নি। আফগানিস্তান ক্রিকেট দেখে গর্বিত প্রাক্তন হেডস্যর। লালচাঁদ রাজপুত (Lalchand Rajput)।
কে এই রাজপুত? মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার। তবে বাইশ গজের ক্রিকেটীয় কীর্তির চেয়েও তাঁকে সকলে বেশি করে মনে রেখেছে কোচ হিসাবে অবদানের জন্য। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দল তখন বিপর্যস্ত। গ্রুপ থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। সুপার এইটের টিকিট মেলেনি। ক্রিকেটারদের বাড়ি আক্রান্ত হচ্ছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে অধিনায়ক করে ঘুরে দাঁড়ানোর ছক সাজাল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোচ হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হল রাজপুতকে। শুরুতেই বাজিমাত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল ভারত। ক্যাপ্টেন কুল জমানার সেই সূচনা। রাজপুতের প্রশিক্ষণেই এক সোনালি অধ্যায়ের শুরু।
পরে সেই রাজপুতের হাতেই তুলে দেওয়া হয় আফগানিস্তান ক্রিকেটের দায়িত্ব। সাল ২০১৬। রশিদ খানদের কোচ করা হল রাজপুতকে। আফগান ক্রিকেটের আঁতুরঘর তখন ভারত। নয়ডায় আফগান ক্রিকেটারদের তালিম দিতেন রাজপুত। সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৪টি জিতেছে আফগানিস্তান। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা – বিশ্বকাপ জেতা তিন দেশকে হারিয়ে বিশ্বক্রিকেটের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে আফগানিস্তান।
শূন্য থেকে শুরু
বিশ্বকাপে কেমন দেখলেন আফগানিস্তানকে? এবিপি লাইভকে রাজপুত বলছিলেন, ‘খুব সত্যি কথা বলতে, ওরা ভীষণ দ্রুত উন্নতি করছে। যেভাবে ওরা ক্রিকেট নিয়ে এগোচ্ছে, এক কথায় অনবদ্য।’
বিশ্বকাপে তিন প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নদের হারিয়েছে আফগানিস্তান। কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে আফগানিস্তানের ক্রিকেট? রাজপুতের বিশ্লেষণ, ‘এখন ওদের পরিকাঠামো অনেক উন্নত। আগে যেখানে দেশে একটা ভাল খেলার মাঠ ছিল না, সেখানে এখন দু’তিনটি স্টেডিয়াম। ওরা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলাও শুরু করেছে। ওদের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট লিগ খেলে। আইপিএল, বিগ ব্যাশ লিগ, দ্য হান্ড্রেড, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলছে অনেকে। তা থেকে ওদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হচ্ছে। ক্রিকেটীয় মুন্সিয়ানা বাড়ছে। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। তার সুফল পাচ্ছে বাইশ গজে।’
আফগানিস্তান ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন রাজপুত। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ‘ওদের তরুণ প্রজন্ম এখন চোখের সামনে রশিদ খান, মহম্মদ নবি, রহমানুল্লাহ গুরবাজ়দের দেখে বড় হচ্ছে। যারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তো বটেই, বিভিন্ন দেশের লিগেও নজর কেড়ে নিয়েছে। রশিদ বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার। আইপিএল অভিষেকেই নজর কেড়েছে গুরবাজ়। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে বেশ কিছু ভাল ইনিংস খেলেছে। রশিদদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আফগানিস্তানের উদীয়মান ক্রিকেটারেরা আরও বড় স্বপ্ন দেখছে। পরিশ্রম করছে। তার সুফল পাচ্ছে আফগানিস্তান।’
যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট
বেশ কয়েক দশক ধরেই আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ২০২১ সালে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর তালিবান অভ্যুত্থান নতুন করে সঙ্কট ডেকে আনে। জনজীবন বিপর্যস্ত। রশিদ, নবিরা অন্য দেশে। দেশের ক্রিকেটের সদর দফতরে অস্ত্র হাতে তালিবান নেতাদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে। নিন্দায় মুখর আফগানিস্তান ক্রিকেটের সেরা মুখ রশিদ খানও। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে, ক্রিকেটও হয়তো ভেন্টিলেশনে চলে যাবে সে দেশে।
কিন্তু বাইশ গজে সেই অস্থিরতার কোনও প্রভাব ফেলতে দেননি ক্রিকেটারেরা। হাশমাতুল্লাহ শাহিদিরা শক্ত হাতে ক্রিকেট দলের রাশ ধরে রেখেছেন। যার ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মাঠে। বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটারদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে আফগানদের ধাক্কায়।
একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। যুদ্ধ। বাতাসে বারুদের ঝাঁঝ। রক্তস্রোত। নৃশংসতা। প্রাণহানি। অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়া। তুষারপাতে তো বছরের বেশ কয়েক মাস জনজীবন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খেলার মাঠ ঢাকা পড়ে বরফের চাদরে। যেদিকে দুচোখ যায়, শ্বেতশুভ্র ধূ ধূ প্রান্তর। এর মাঝেই বাইশ গজে কঠোর সাধনা।
আফগান ক্রিকেটের সঞ্জীবনী কী? রাজপুত বলছেন, ‘ক্রিকেট নিয়ে ওরা ভীষণ আবেগপ্রবণ। সেই সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমী। ওদের মতো এত পরিশ্রমক্ষমতা আমি খুব কম ক্রিকেটারের মধ্যে দেখেছি। আমি কোচ থাকাকালীন যদি ওদের কোনও সময়ে বলতাম, চলো ছেলেরা আধ ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করে নিই, সকলে সমস্বরে বলত, কেন আধ ঘণ্টা! আমরা এক ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করব। এতটাই আবেগপ্রবণ ক্রিকেট নিয়ে। বলত, ক্রিকেট ছাড়া আমাদের দেশে আর কিছুই নেই। না রয়েছে কোনও চাকরি, না অন্য সুযোগ। ক্রিকেটই আমাদের রুজি-রুটি। ক্রিকেটই পারে আমাদের একটা ভাল জীবন দিতে। তাই ক্রিকেট সাধনায় ওদের কোনও খামতি নেই। বিশ্বমঞ্চেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই জেদ আর সংকল্পকে সম্বল করেই।’
মেরুদণ্ড ঘরোয়া ক্রিকেট
বলা হয়, যে কোনও দেশের ক্রিকেটীয় শক্তি নির্ভর করে থাকে তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মেরুদণ্ডের ওপর। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া হোক বা রানার্স ভারত, ঘরোয়া ক্রিকেটের নিক্তিতে প্রতিপক্ষদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট কেমন? রাজপুত বলছিলেন, ‘আমি কোনওদিন আফগানিস্তানে যাইনি। যে সময় কোচিং করিয়েছি, আফগানিস্তানের পরিকাঠামো সেরকম উন্নত ছিল না। তখন ওরা প্র্যাক্টিস করত ভারতের মাটিতে। শুধু নয়ডাতেই ওদের প্রশিক্ষণ করিয়েছি। তবে ওদের ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো এখন অনেক উন্নত। তিন-চারদিনের ম্যাচ খেলছে। ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলছে। টি-টোয়েন্টি খেলছে। আমাদের যেমন রঞ্জি ট্রফি খেলা হয় রাজ্য ভিত্তিক, ওদেরও তেমন প্রদেশ ভিত্তিক দল রয়েছে। যেমন কান্দাহার, কাবুল। এরকম পাঁচ-ছয়টি দল রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে খেলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে জোর দেওয়াতেই ওদের সাফল্যের সরণি তৈরি হচ্ছে।’
যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কোনও নেতিবাচক প্রভাব ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখেছেন? ‘২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত আমি যখন কোচিং করিয়েছি, ক্রিকেটারদের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া দেখিনি। ওদের ক্রিকেট বোর্ড সবরকমভাবে সাহায্য করত। ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নিয়ে ওদের ভাবতে দেখিনি,’ বলছিলেন রাজপুত।
নতুন শক্তির অভ্যুত্থান
আগামী পাঁচ বছরে কোথায় দেখছেন আফগানিস্তানের ক্রিকেটকে? রাজপুতের কথায়, ‘আমি নিশ্চিত, ওরা বিশ্বকে প্রমাণ করতে চায় যে, ক্রিকেটে ওরাও এখন সেরাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। আগে এশিয়ার সেরা দল মনে করা হতো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে। পরে বাংলাদেশও নজর কাড়ে। কিন্তু আফগানিস্তান এখন ক্রিকেট বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে টক্কর দিতে তৈরি। সেটা ওদের পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যত দিন যাবে, ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।’
অভিজ্ঞ কোচের বিশ্লেষণ, ‘ওদের ব্যাটিং ভাল করতে হবে। বোলিং বরাবরই ভাল। এখন সেটা আরও ভাল হয়েছে। স্পিন আক্রমণ তো শক্তিশালী ছিলই, এখন পেসাররাও ভাল বল করছে। ওয়ান ডে ক্রিকেটে ব্যাটাররা যদি ২৯০ রান তুলতে পারে, তাহলে এই আফগানিস্তান দ্রুত সীমিত ওভারের ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা শক্তি হয়ে উঠবে।’
কে বলে আফগানিস্তান মানে শুধু কাবুলিওয়ালার কাহিনি? ক্রিকেট এখন আফগান জীবনের নতুন অঙ্গ।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।
আরও পড়ুন: আপনার প্রিয় ক্রিকেটারকে কি ছেড়ে দিল, না ধরে রাখল তাঁর ফ্রাঞ্চাইজি ? দেখুন পূর্ণাঙ্গ তালিকা
Read More